ছেলেকে বড় করে তুলতে গিয়ে নিজের জীবন হারানো এক মায়ের কাহিনী

 


আমি একজন বিধবা মহিলা, বয়স এখন ৬০ বছর। আমি আগে একজন স্কুল শিক্ষিকা ছিলাম।

আমার একমাত্র ছেলে আছে, যার বয়স এখন ৩৬ বছর। তার নাম আশিক আদনান দিপ, এবং সে অস্ট্রেলিয়ায় বাস করে। আমার স্বামী মারা গেলে আমার বয়স ছিল ৪০ বছর, আর আমার ছেলে তখন ১৬ বছর বয়সী ছিল।


ছেলেকে একা বড় করেছি, প্রচুর কষ্ট করেছি, কিন্তু কখনো তাকে অভাববোধ করতে দেইনি। সব সময় চেষ্টা করেছি তার সব চাহিদা পূরণ করার, যাতে কখনোই সে মনে না করে যে তার বাবা থাকলে এই চাহিদা পূরণ হতো। দেশের সেরা স্কুল, কলেজ, এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছে। এরপর, উচ্চশিক্ষার জন্য ছেলেকে অস্ট্রেলিয়ায় পাঠিয়েছি, এবং সমস্ত খরচ একা হাতে সামলেছি। নিজের দিকে একদম নজর দিইনি। আমার জীবনের লক্ষ্য ছিল ছেলের সফলতা এবং তার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করা। সবাই আমাকে সফল মা মনে করে, এবং আমি নিজেও গর্ব অনুভব করি।


গত সপ্তাহে আমার এক পুরানো বান্ধবী লিপির সাথে দেখা হলো। তার ছেলে আরিফ আমার ছেলের সঙ্গে একই স্কুলে পড়ত। তবে, তাদের বন্ধুত্ব তেমন ভালো ছিল না, সম্ভবত আমার বা আমার ছেলের কারণে।

আমি সব সময় চাইতাম, আমার ছেলে শুধু ভালো ছাত্রদের সঙ্গেই মিশুক, যারা পড়াশোনায় প্রতিযোগিতা করে। এতে তার পড়াশোনার প্রতি আরও প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব তৈরি হবে।

লিপি বলতো, "দেখ, আমরা দুজন কত ভালো বন্ধু, কিন্তু আমাদের ছেলেদের মধ্যে বন্ধুত্ব হলো না।"

লিপির ছেলে আরিফ সব ক্লাসে টেনেটুনে পাশ করতো, কিন্তু সব সময়ই স্কুলের খেলাধুলা ও অন্যান্য কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতো। লিপি খুশি ছিল তার কর্মকাণ্ড নিয়ে।

লিপির কথা ছিল, "আমার ছেলে ফেল করে না, পাশ করে গেলেই হলো। সবার ছেলে তো প্রথম হবে না। আরিফ পড়াশোনায় তেমন ভালো না, কিন্তু তার অন্য কাজগুলো কত সুন্দর!"

আমার কাছে লিপির এই কথা অসহনীয় লাগতো। মনে হতো, তার ছেলে পড়াশোনায় পিছিয়ে আছে। এমন মায়ের উচিত না ছেলেকে স্কুলের এক্সট্রা কার্যক্রমে সময় নষ্ট করতে দেওয়া।

দিপ কলেজে নটরডেম কলেজে ভর্তি হলো, আর আরিফ সাধারণ একটি কলেজে ভর্তি হলো। তারপর তাদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেলো।

গত সপ্তাহে শপিং মলে হঠাৎ করে ওদের সাথে দেখা হলো। আমাকে দেখতে পেয়ে আরিফ বলল,


- "আন্টি, আমাকে চিনতে পেরেছেন? আমি আরিফ।"


আরিফকে দেখে আমি চিনতে পারিনি। শেষ যে সময় আরিফকে দেখেছিলাম, তখন সে কলেজে ভর্তি হতে যাচ্ছিল। এখন সে এক পরিপূর্ণ ভদ্রলোক। আরিফ আমাকে তার মায়ের কাছে নিয়ে গেল। লিপি একটি দোকানে বসেছিলো, আর আরিফ তার জন্য নানা রংচঙে থ্রি-পিস কিনছিল।

আমি আর লিপি সব সময় শাড়ি পরতাম, তাই আমি একটু অবাক হলাম। লিপি বারবার জানতে চাইছিলো,

- "তুই বল, আমি কোনটা কিনবো, কোনটায় মানাবে?"

আরিফ হঠাৎ বলল, "অ্যান্টি, আপনি যেটা পছন্দ করবেন, আম্মা সেটাই কিনবে।" আমি একটি থ্রি-পিস পছন্দ করলাম, আরিফ সেই একই থ্রি-পিস দুইটা কিনে দিলো।

আরিফ এবং লিপি কেনাকাটার ফাঁকে গল্প করছিল। তাদের কেনাকাটার ধরন দেখে মনে হচ্ছিল তারা কোথাও বেড়াতে যাচ্ছে।

আরিফকে লক্ষ্য করে দেখলাম, কিভাবে সে তার মায়ের সাথে সহজ ও স্বাভাবিকভাবে কথা বলছে, যেন সে তার মেয়ে নিয়ে শপিং করতে এসেছে। তারা আমাদের একটি রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেল। আরিফ খাবার অর্ডার করে শেষে বলল,

- "আম্মা, কফি খাবেন না আইসক্রিম?"

লিপি বলল, "প্রথমে কফি খাবো, তারপর আইসক্রিম খেয়ে বাসায় যাবো।"

আমি বললাম, "আমি শুধু কফি খাবো।"

লিপি বলল, "তাহলে আইসক্রিম খাওয়া বাদ।"

আরিফ জানিয়েছে তারা কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিনে বেড়াতে যাচ্ছে, লিপিকে নিয়ে যাবে, যদিও এটি তার অফিসিয়াল টুর। আরিফ একটি বায়িং হাউসে কাজ করে এবং ব্যস্ত থাকলেও মা’কে শপিং করতে নিয়ে এসেছে। তার স্ত্রী একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে কাজ করে এবং তাদের সন্তান তার নানির বাড়িতে রয়েছে। শপিং শেষ হলে আরিফ তার মেয়েকে শ্বশুর বাড়ি থেকে তুলে নেবে।

আমি সেদিন একটা বিছানার চাদর আর কিছু বাজার করতে গিয়েছিলাম। কিছুই কিনি না, কেননা আমার কিছু কিনতে মন ছিল না। আমি শুধু আরিফকে দেখছিলাম। আরিফ কিভাবে তার মায়ের প্রতি যত্নশীল, নিজেই তার মায়ের পায়ে স্যান্ডেল পরিয়ে দিলো। আরিফ বলল, "আম্মা, মূল্য দেখবেন না, আরাম পেতে হবে।"


আরিফ তার মায়ের জন্য সানগ্লাসও কিনলো। আরিফ বলল,

- "মা, সানগ্লাস কিনতে হবে, কারণ আপনি যখন সমুদ্রের ধারে হাটবেন তখন চোখে রোদ লাগবে।"

আরিফ ও লিপির দেখানো এই মমত্ববোধ আমাকে গভীরভাবে স্পর্শ করলো। আমি অনুভব করলাম, আমি জীবনের কাছে হেরে গেছি। আমার মনে হলো, আমি একজন ব্যর্থ মা, যে তার ছেলেকে এত বড় বানাতে গিয়ে এমন একজন সফল ও বড় মানুষ বানিয়ে ফেলেছি যে, তার নাগালে আমি আর কখনো পৌঁছাতে পারবো না!

আরিফ কয়েকবার দিপের কথা জানতে চেয়েছে। আমি দিপের নম্বর দিইনি। বলেছি, "বাসায় আছে, নোট বইয়ে লেখা," কারণ দিপের অনুমতি ছাড়া আমি তার নম্বর কাউকে দিতে চাইনি। দিপ আমাকে বলে,

- "মা, আমি অনেক ব্যস্ত, যখন তখন কল দেবো না, এতে আমার ডিসটার্ব হয়। তুমি এখনও অস্ট্রেলিয়া আর বাংলাদেশের সময়সূচির মধ্যে এডজাস্ট করতে পারো না?"

আরিফ আমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে বলল, "এটা আপনার জন্য," এবং আমার জন্য একটি থ্রি-পিস কিনেছে। আমাকে আরিফের এই চিন্তা দেখে আমার চোখে জল চলে আসছিল।


আরিফ আরো বলল,

- "আন্টি, আমি মোবাইল নম্বর সেভ করে দিয়েছি, যখন খুশি কল দিবেন, আমি এসে আপনাকে বাসায় নিয়ে যাবো।"

আমি বললাম,

- "তুমিও তো ব্যস্ত থাকো।"

আরিফ বলল,

- "আন্টি, আপনার জন্য আমি সব সময়ই ফ্রি আছি।"

তারপর আরো বলল,

- "আন্টি, আপনি তো একা থাকেন, আমাদের সাথে কক্সবাজার চলুন। আম্মার একজন সঙ্গী হবে, আম্মার আরও ভালো লাগবে।"


আমি মনে মনে বলছিলাম, "লিপি আমাকে কক্সবাজারে নিয়ে যাবে? আমি সমুদ্র দেখবো না, আমি শুধু দেখবো একজন ছেলে তার মাকে কত যত্ন করছে।"

আমি আরিফকে বললাম,

- "আরিফ, তুমি সত্যিই ঠিক বলেছো। লিপির সাথে দীর্ঘদিন পর দেখা হবে, আমারও ভালো লাগবে তোমাদের সাথে বেড়াতে গেলে। কিন্তু দিপকে তো বলতে হবে। আমি আজ দিপের সাথে কথা বলে তোমাকে জানাবো।"

লিপি আমার কথায় অবাক হলো। সে এত সহজে আমার কক্সবাজার যাত্রায় রাজি হওয়া ভাবতে পারেনি। লিপি আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল,

- "শাহী, প্লীজ চলো, আমার খুব ভালো লাগবে।"

এরপর তারা চলে গেলো। আমি আমার অন্ধকার ঘরে ফিরে এসে, গভীর চিন্তায় ডুবে গেলাম। রাতের বেলা দিপের সাথে হওয়া কথাগুলো ভাবতে লাগলাম।

দিপ অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে নিজের বিয়েটা করলো। আমি শুধু টেলিফোনে তাদের আশির্বাদ করলাম। দিপের স্ত্রী পড়াশোনা শেষ না হওয়া, শিশুর অসুবিধা ইত্যাদি নানা কারণে তারা বাংলাদেশে আসেনি। এবার দিপ আমাকে অস্ট্রেলিয়ায় যাওয়ার জন্য কাগজপত্র ঠিক করার কথা বলেছিল। গতকাল কল দিয়ে বললো, এবার তারা ছুটিতে আমেরিকা যাবে। দিপ আমাকে বলেছে, "আমরা সবাই চেষ্টা করবো আগামী বছর দেশে আসার, তুমি মন খারাপ করো না।"

আমি মন খারাপ করিনি। আজ আমি বুঝতে পারলাম, শুধু ভালো ছাত্র হওয়া আর সব সময় প্রথম হওয়া সন্তানদের সেরা করে না। আমি শুধু আমার ছেলেকে পরীক্ষার খাতায় এবং চাকরির বাজারে সেরা হতে শিখিয়েছি, কিন্তু সেরা মানুষ হতে শিখাইনি। আমি তাকে শুধু প্রতিযোগিতা করতে শিখিয়েছি, কিন্তু সবাইকে নিয়ে ভাবতে শিখাইনি।

আমি সব সময় দিপকে ভালো জিনিস কিনে দিয়েছি, তার সব চাহিদা পূরণ

 করেছি। কিন্তু আমি কখনো আমার নিজস্ব চাহিদা দেখাইনি।

আমি দিপকে কল দিবো না কক্সবাজার যাওয়া নিয়ে। এটি আরিফকে বলার জন্য বলেছি। আজ লিপিদের সাথে দেখা হয়ে ভালো হলো। এখন থেকে আমি আমার ছোট ছোট চাওয়া পূরণের দিকে মনোযোগ দিবো। ছেলেকে নিয়ে আমার ভাবনা শেষ।

আমি ছেলেকে তার ভালো থাকার জন্য সব কিছু করেছি, তার কাছ থেকে আর কিছু পাওয়ার নেই। ছেলের অস্ট্রেলিয়া বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা থেকে, গত দুই বছর ধরে আমি সঞ্চয় করেছি। এখন আমি লিপির সাথে কক্সবাজার এবং সেন্টমার্টিন ঘুরে আসবো। তারপর নিজের জন্য ভাববো।

সংগৃহীত

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Thanks for being with us.

নবীনতর পূর্বতন